স্পেনের ইবিজা দ্বীপে অবস্থিত বিখ্যাত স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ সাবলিমোশন। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁ হিসেবেই পরিচিত। এই রেস্তোরাঁয় খেতে আসা অতিথিদের জনপ্রতি খরচ হয় প্রায় দুই হাজার ৩৮০ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দুই লাখ টাকার চেয়ে বেশি।
রেস্তোরাঁটির বিশেষত্ব হলো এখানে খাবারের সঙ্গে চারপাশের আবহ এবং শব্দের মিল বন্ধন করা হয়। আগত অতিথিদের অভিনব উপায়ে সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি তাদেরকে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির দুনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়াও নাচ-গান পরিবেশনসহ বিভিন্ন রকমের যন্ত্রসংগীত ও জাদু প্রদর্শনীর সমন্বয়ে এক জাঁকজমকপূর্ণ অভিজ্ঞতা দেয়া হয় অতিথিদের।
বছরে মাত্র চার মাস খোলা থাকে রেস্তোরাঁটি। প্রতি বছর স্প্যানিশ সামার শুরু হলেই সেখানে খেতে যেতে পারেন অতিথিরা। প্রতিদিন মাত্র দুইবার ডাইনিংয়ের সুযোগ পান আগতরা। প্রতিবারে মোট ১২ জন অতিথি প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে উপভোগ করেন ২০ ধরনের স্পেশাল সব খাবারের মেনু।
রেস্তোরাঁটি বসে খাবার উপভোগ করার জন্য আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। বুকিং দেয়া অতিথিদের রেস্তোরাঁয় নিয়ে আসা হয় এক লাখ ডলার মূল্যের রেঞ্জ রোভারে করে। রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় অতিথিদের।
সেখানে সবাইকে টিকিটের একটি খাম দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হলো এই টিকিট আর খাম দুটোই খাওয়া যায়। যার স্বাদ অনেকটা রাস্পবেরির মতো। খামগুলোর যেকোনো একটিতে থাকে সোনালি রঙের টিকেট। যে ব্যক্তি এই বিশেষ টিকেট পাবেন, তার জন্য পরবর্তীতে থাকবে আকর্ষণীয় সব চমক।
টিকিটের পাশাপাশি অতিথিদের বিভিন্ন ধরনের অ্যাপিটাইজার এবং হুইস্কি শট দেওয়া হয়। এরপর ক্যাপসুল লিফটে করে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাইনিংয়ে। বিশাল আকৃতির ডাইনিং রুমে টেবিলসহ চার দেয়ালের সম্পূর্ণ অংশ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে মোড়া।
রুমের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরোটাই ব্যবহার করা হয়েছে ডিজিটাল স্ক্রিন। ডাইনিং টেবিলটি লেজার লাইট প্রজেকশনের প্রভাবে দেয়ালের সঙ্গে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ফলে অতিথিদের তখন মনে হয় তারা অন্য কোনো স্থানে বসে খাবার উপভোগ করছেন।
রুমে ঢোকার সময় তাদের পরিয়ে দেয়া হয় ভিআর হেডসেট। যার সাহায্যে মনোমুগ্ধকর কাল্পনিক পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারেন অতিথিরা। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ব্যবহার করে নিজের ইচ্ছে মতো বিশ্বের যে কোনো দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করাসহ স্কাই ডাইভিং কিংবা রোলার কোস্টারে চড়ার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।
খাবার হিসেবে অতিথিদের প্রথমে ছোট চার কোণা অতি সুস্বাদু এক ধরনের খাবার দেয়া হয়। সঙ্গে তাজা ফিশ কারি ও ওয়েস্টার পরিবেশন করা হয় হিমায়িত নাইট্রোজেনের জমানো অলিভ অয়েল দিয়ে। পানীয় হিসেবে দেওয়া হয় শ্যাম্পেইন।
পাশাপাশি ঘরের মধ্যে সমুদ্র তলদেশের আবহ তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে গভীর সমুদ্রের শব্দ ব্যবহার করে এক প্রকার বাস্তবিক সামুদ্রিক আবহ তৈরি করা হয়। এরপর শামুকের খোলসের মধ্যে সুস্বাদু মাছ পরিবেশন করা হয় অতিথিদের। এসময় অতিথিদের চারপাশে ঘেঁষে ডলফিন সাঁতরে যাওয়ার আবহ তৈরি করা হয়।
পরবর্তীতে কাঁচের গোলকে করে পরিবেশন করা হয় বিশেষ ধরনের সবজি। এটি এমনভাবে পরিবেশন করা হয় যে, অতিথিদের মনে হয় খাবারটি যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে। একসময় রুমের চারপাশে জ্বলন্ত আগুনের দৃশ্য ধারণ করে। এসময় ওয়েটাররা বিভিন্ন ধরনের সুশি পরিবেশন করেন। রুমের আবহের সঙ্গে মিল রেখে এসময় ‘এসিডিসি’র ‘হাইওয়ে টু হেল’ গানটা বেজে ওঠে।
এরপর রুমের চারপাশে বাগানের দৃশ্য ধারণ করলে এক ধরনের সালাত পরিবেশন করা হয়। ডিশটি এমনভাবে পরিবেশন করা হয়, যা দেখতেও সবজি বাগানের মতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে অতিথিরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী চারপাশের আবহ সৃষ্টি করার সুযোগ পান।
চলন্ত রেলগাড়ি বা উড়োজাহাজের ভেতরের আবহ সৃষ্টি করে তারা তাদের খাবার উপভোগ করতে পারেন। এসময় ‘ব্রিটনি স্পিয়ার্স’ এর ‘টক্সিক’ গানটা বেজে ওঠে। গানের তালে তালে বিমানবালার বেশে কর্মীরা নাচ প্রদর্শন করতে করতে অতিথিদের শ্যাম্পেইন পরিবেশন করে। এরপর চমকে দেয়া হয় সোনালি টিকেট জয়ী অতিথিকে। এসময় তার শৈশবের কোনো স্মৃতিচারণ করা হয় তার সামনে।
পরবর্তীতে সবাইকে সার্কাসের রঙের দুনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় চোখ ধাঁধানো দৃশ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে। এসময় ছোট ছোট নাগরদোলায় করে বিভিন্ন ক্ষুদ্রাকৃতির পিঠা, মিষ্টান্ন এবং স্যান্ডউইচ পরিবেশন করা হয়। সবশেষে পুরো কক্ষটিতে নাইট ক্লাবের আবহ তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে শেষ পাতে খাবার হিসেবে চকলেট কেক দেয়া হয়। তবে তা এমনভাবে পরিবেশন করা হয়, যে কেউ দেখলে মনে করবে খাবারটি যেন শূন্যে ভাসছে।
রেস্তোরাঁটিতে শেফ থেকে শুরু করে শিল্পী, জাদুকর, ডিজে এবং টেকনিশিয়ানসহ মোট ২৫ জন অতিথিদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। রেস্টুরেন্টের উদ্যোক্তা ও প্রধান শেফ প্যাকো রোন্সেরোর তিন তারকা প্রাপ্ত একজন বিখ্যাত শেফ। এছাড়া খাবারের সঙ্গে শব্দের যোগাযোগ সৃষ্টির কাজটি করেছেন বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক ওয়ালি লোপেজ। অন্যদিকে জাদু প্রদর্শন করেন বিখ্যাত জাদুশিল্পী জর্জ ব্লাস। এরকম কাল্পনিক আবহে খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা নিতে টাকা খরচ করতে কেউই কার্পণ্য করবেন না নিশ্চয়ই। হাজার হোক, শখের তোলা যে আশি টাকা।