




…………………………





মাত্র ২২৫ টাকা বেতনে মালির চাকরি করতেন ওহিদ শেখ। এর মধ্যে ১৯৭৮ সালে গাছের চারা ফেরি করে বিক্রি শুরু করলেন। রংপুর শহরের কাচারি বাজারে অফিসপাড়ায় রাস্তার পাশে দাঁড়াতেন গাছের চারা হাতে নিয়ে। দিনে একটি-দুটি করে চারা বিক্রি হতো। এরপর মানুষের বাসাবাড়িতে গিয়ে গাছের কাটিং ও কলম করা শুরু করলেন।
…
আস্তে আস্তে এ কাজে ডাক আসতে থাকে। যে যা টাকা দিতেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। চারা উৎপাদন, কলম তৈরি-এই করতে করতে দ্রুতই একটি নার্সারি গড়ে ওঠে ওহিদ শেখের। এখন নিজের ৬ একর ও ২৬ একর বর্গা জমি নিয়ে তাঁর নার্সারির আয়তন ৩২ একর। ছেলের নামে এর নাম রেখেছেন নাসিম নার্সারি। দীর্ঘ সময় ধরে চারা উৎপাদনে অবদানের জন্য নার্সারি শাখায় ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদক পান তিনি। রাজধানীতে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে নেন সেই পুরস্কার।





…………………………





ওহিদ শেখের বাড়ি রংপুর সদর উপজেলার পাগলাপীর এলাকায়। বয়স এখন ৬৮ বছর। তিনি স্কুলেই যাননি কোনো দিন। তবে অক্ষরজ্ঞান পেয়েছেন বাড়িতে। নাম দস্তখত করা শিখেছেন। নিজে পড়াশোনা না করলেও আট সন্তানকে পড়াশোনা করিয়েছেন। ওহিদ শেখ জানান, ১৯৭৭ সালে কৃষি বিভাগে (তৎকালীন হর্টিকালচার ফার্ম) মালি পদে চাকরি নেন তিনি। যোগদান করেন পাবনায়। পরের বছর বদলি হয়ে আসেন রংপুরে। ওই সময় রংপুরের হর্টিকালচার ফার্মে (বর্তমানে চিড়িয়াখানা) কাজ শুরু করেন। বেতন ছিল মাত্র ২২৫ টাকা।
…
ওহিদ শেখ বললেন, ‘মালির চাকরি নেওয়ার আগেই আমার গাছের প্রতি শখ ছিল। গ্রামে গাছের নিচে বসলে বেশ শান্তি লাগত। মন ভালো হয়ে যেত। যেখানে গাছ থাকত, সেখানে একটা শান্তি শান্তি ভাব থাকত। পরিবেশটা ভালো লাগত। ভাবতাম, গাছ তাহলে পরিবেশেরও ভালো করে।’ স্বল্প বেতনের চাকরিতে সংসার চলে না। দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না। ভাবলেন, যা করার গাছগাছালি নিয়েই করবেন। অফিস ছুটির পর কর্মস্থল কৃষি ফার্ম থেকে ফুল-ফলের চারা কিনে তা প্রতিদিন ফেরি করে বিক্রি করতে লাগলেন। রংপুর শহরের কাচারি বাজারে অবস্থিত সরকারি অফিসগুলোর সামনে সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে চারা বিক্রি করতেন ওহিদ শেখ।





…………………………





বাসায় ফেরার পথে সরকারি কর্মকর্তারা টুকটাক ফুল গাছ কেনা শুরু করলেন। ওহিদ কারও কারও সঙ্গে গিয়ে বাড়িতে যত্ন করে সেই চারাও লাগিয়ে দিয়ে আসতেন। এতে আরও কিছু টাকা বাড়তি আসত তাঁর। ওহিদ শেখের আগ্রহ দেখে অফিসের তখনকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইউসুফ আহমেদ শহরের জুম্মাপাড়ায় তাঁর নিজের বাড়িতে ১৮ শতাংশ জমি চারা করার জন্য দেন। অফিস শেষে সেই জমিতে বিভিন্ন জাতের চারা উৎপাদন করতে লাগলেন আর তা ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। আয় বাড়তে থাকে ওহিদের। পরের বছর নিজেই শহরের হনুমানতলা এলাকায় পাঁচ হাজার টাকায় এক একর জমি বন্ধক নেন। সেখানেও উৎপাদন করেন বিভিন্ন প্রজাতির চারা। শহরের গাছপ্রিয় মানুষজন সেখান থেকে সহজে চারা কিনতে পারতেন। ফলে ক্রেতা বাড়তে থাকে ওহিদের।
…
ওহিদ শেখের নাসিম নার্সারির জমির পরিমাণ এখন ৩২ একর। কলম আর চারা মিলে আছে প্রায় ১০ লাখ। বিভিন্ন প্রজাতির বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছে সমৃদ্ধ ওহিদের নার্সারি। তিনি জানান, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত রংপুরের সদর উপজেলার শলেয়া শাহ, হরকলি, রতিরামপুর ও শহরের মডার্ন মোড় এলাকায় নিজের ৬ একর জমি এবং ২৬ একর বর্গা জমি নিয়ে ৩২ একর জমিতে গড়ে তুলেছেন এই নার্সারি। এখানে এখন আমের চারা বেশি। হাঁড়িভাঙা, ল্যাংড়া, রুপালি, আম্রপালি, গোপালভোগ, আশ্বিনা, মিশ্রিভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ফজলিসহ নানা জাতের আমের কলম বিক্রি করেন। লিচুর মধ্যে আছে বেদানা, চায়না, বোম্বাই, মাদ্রাজি প্রজাতির কলম।





…………………………





নাসিম নার্সারিতে আকাশমণি, একাশিয়া ক্রস, ম্যানজিয়াম, রেইনট্রি, আমড়া, ডালিম, জাম, কাঁঠাল, লেবু, পেয়ারা, জলপাই, পেঁপের চারা ও কলম আছে। নিম, আগরসহ দেশীয় নানা প্রজাতির ঔষধি গাছের চারাও রয়েছে তাঁর। ওহিদ শেখ বললেন, ‘আমি প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি সবুজ সার ব্যবহার করি। এ কারণে চারা সুন্দর এবং মানও ভালো হয়। সে জন্য আমার নার্সারির চারার চাহিদা বেশি।’
ওহিদ শেখের নার্সারিতে প্রায় ১০০ লোক কাজ করেন এখন। তাঁদের কেউ দৈনিক ভিত্তিতে এবং কেউ মাসিক বেতনে নিযুক্ত। মাসে সর্বনিম্ন ৭ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেন। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জনকে বিনা পারিশ্রমিকে গাছের পরিচর্যার বিষয়ে হাতেকলমে শেখান তিনি। নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলার আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমি তাঁর কাছ থেকে কলম করা শিখছি। নিজের এলাকায় একটি নার্সারি করেছি।’
..
এ নার্সারির জন্য বিপুলসংখ্যক মাটির পাত্রের দরকার হয়। পাশের মমিনপুর ইউনিয়নের পালপাড়ার প্রায় ২০টি পরিবার তাদের তৈরি মৃৎপাত্রের প্রায় সবই ওহিদ শেখের নার্সারিতে বিক্রি করে। এই নার্সারির ওপর নির্ভর করে এসব পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে বলে জানান নিপা রানী পাল, জ্যোৎস্না রানী পাল, অনতী রানী পাল।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, নার্সারিতে নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা কাজ করছেন। কেউ গাছের কাটিং করছেন। কেউবা পচা পাতা পরিষ্কার করছেন। কেউ পাত্রে মাটি ভরছেন। পচানো পাতা গর্তে ফেলে সবুজ সার তৈরি করছেন কয়েকজন।
প্রায় ১২ বছর এই নার্সারিতে কাজ করছেন এলাকার ইউনুস আলী। তিনি বলেন, ‘এই নার্সারিতে এলাকার অনেক মানুষের চাকরি হইছে। কামের জন্য অন্য জায়গাত যাওয়া লাগে না। বছরের পর বছর ধরি অ্যাটে কাজ করি যাইতোছি।’ সাত বছর ধরে আছেন পাগলাপীর এলাকার মোজাহার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক কাম (কাজ) শিখছি। অ্যাটে কাজ করিয়া ভালো টাকাও পাই।’
ওহিদ শেখের নার্সারির গাছের চারা উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজার চারা বিক্রি হয় তাঁর নার্সারি থেকে। প্রকারভেদে একেকটি চারা বা কলম ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
…
ওহিদ শেখ ২০০৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। পুরো জীবন তিনি দেশের সবুজায়নে কাজ করেছেন। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আট সন্তানকে পড়াশোনা করিয়েছেন। দুই ছেলে এখন নার্সারি ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। তিন ছেলে এখনো পড়ছেন। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে চারটি পাকা ও আধা পাকা ঘর করেছেন। বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার চারা ও কলম বিক্রি হয় বলে জানান ওহিদ শেখের ছেলে মিলন শেখ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক সরওয়ারুল আলম বলেন, ‘ওহিদ শেখ আমাদের গর্ব। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। পরিশ্রম করে তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অন্যদের কাজের সংস্থান করেছেন। তাঁকে রোল মডেল ধরে অনেকে নার্সারি পেশায় এসেছেন।’
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো।