Sat. Sep 23rd, 2023

    …………………………

    বাবার আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো নয়। সুযোগ হয়নি উচ্চশিক্ষা লাভেরও। ‘সম্বল’ বলতে ছিল কেবল বড় হওয়ার স্বপ্ন। ওদিকে দীর্ঘদিনের বেকার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এমনই দিশাহারা অবস্থায় ছোট্ট একটি ঘটনা যেন লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ বাতলে দেয়। সামান্য পুঁজি সংগ্রহ করে বাড়ির আঙিনায়                                                   ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করেন মুরগি পালন। কঠোর শ্রম, সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি আর অফুরান ধৈর্য তাঁকে সাফল্য এনে দিয়েছে। ২১ বছরের ব্যবধানে তোফাজ্জল হোসেন এখন কেবল সফল পোল্ট্রি খামারি নন, উদ্যোক্তাদের ‘সাহস’ও।

    গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের পাথারপাড়া গ্রামের মৃত হাফিজ উদ্দিনের ছেলে তোফাজ্জল হোসেন স্থানীয় আজিরন পোল্ট্রি খামারের স্বত্বাধিকারী। এই খামারির প্রেরণায় আশপাশের কয়েক গ্রামের প্রায় শখানেক যুবক ঝুঁকেছেন পোল্ট্রি ব্যবসায়।

    …………………………

    সফল খামারি তোফাজ্জল কথা বলেন তাঁর কঠিন পথচলা নিয়ে। বললেন, ‘১৯৯৬ সালের দিকের কথা। ২৪ বছর বয়সী এক বেকার যুবক। স্বজনরা আয়-রোজগারের একটা পথ বেছে নেওয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষা বা পুঁজি কিছুই নেই আমার। ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসার ধারণা পেলেও                                                                  স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। এরই মধ্যে গাজীপুর সদর উপজেলার সালনা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাই। সেখানে উঠানে মুরগি পালন (মাংস উৎপাদন) ব্যবস্থা আমাকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে। বাড়ি ফিরে নেমে পড়ি পুঁজি সংগ্রহে।’

    তোফাজ্জল জানান, দীর্ঘ ছয় মাসের চেষ্টায় সামান্য পুঁজির ব্যবস্থা করেন তিনি। এরপর বাড়ির আঙিনায় অল্প খরচে একটি ছাপরা ঘর তুলে তাতে খুব ক্ষুদ্র পরিসরে মুরগি পালন (মাংস উৎপাদন) শুরু করেন। ৪০ দিন পর তা বিক্রি করে তিন হাজার টাকা লাভ হয়। সামান্য এ লাভ থেকেই সাহস বেড়ে যায়। পরে ধারদেনা করে জয়দেবপুর এলাকার একটি হ্যাচারি থেকে ৫০০ লেয়ার মুরগি (ডিম উৎপাদন) কিনে আনেন। কিন্তু এর ২৫ দিনের মাথায়ই স্বপ্নযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘গাম্বা রোগ’। এই রোগে ২০০ মুরগি মরে যায়। পুঁজিও হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু দমে যাননি। মামাতো ভাই                                                                       লিপটন সরকারকে অংশীদার করে কিছু পুঁজি পান। তা দিয়ে এবার ৫০০ ব্রয়লার মুরগি কেনেন। ৪০ দিন পর তা বিক্রি করে লাভ হয় আট হাজার টাকা। এরপর বড় ভাই আবদুল ওয়াহাবের কাছ থেকেও পর্যায়ক্রমে কিছু টাকা নেন। পাশে একটি শেড তৈরি করে আবার ৫০০ লেয়ার মুরগি কেনেন।

    …………………………

    এই সফল খামারি জানান, শুরুর দিকে কাঠের বাক্স তৈরি করে এর ভেতরে মেঝেতে মুরগি পালন করতেন। পরে বিআরডিবি থেকে ১৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খাঁচা কেনেন। একপর্যায়ে পুরোদমে ডিম উৎপাদন শুরু হয় খামারে। ওই সময় ডিম খেলে রোগ হয় (আফলাটক্সিন)—দেশজুড়ে এমন অপপ্রচারে ডিমের দর পড়ে যায়। ফলে ওই দফায় লোকসান গুনতে হয়। ওই ধাক্কায় অনেক খামারিই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেন। কিন্তু উদ্যম হারাননি তিনি। কয়েক মাস পর ওই আতঙ্ক কেটে গেলে                                                                   ডিমের বাজার চাঙ্গা হয়। তখন প্রতি মাসে গড়ে লাভ হতো ২০ হাজার টাকা। পুঁজি বেড়ে যাওয়ায় স্বপ্নও বড় হয়। পাশেই আরেকটি শেড তৈরি করে আরো এক হাজার ৩০০ মুরগি কিনে লালন-পালন শুরু করেন। আলাদা দুটি শেডে লেয়ার মুরগির সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার ৮০০। তখন পর্যন্ত তিনি কোনো                                                              কর্মচারী রাখেননি। বড় ভাই আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে নিজেই সব কাজ করতেন।

    প্রচণ্ড পরিশ্রমের সেই দিনগুলো স্মরণ করে এই সফল খামারি বলেন, ‘খামার শুরুর সময়টাতে এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। যোগাযোগব্যবস্থাও ছিল নাজুক। মাওনা চৌরাস্তা থেকে মুরগির খাদ্য কিনে একটি পুরনো সাইকেলে সব সময় নিজেই তা খামারে নিতাম। বড় ভাই ও আমি রিকশাভ্যান চালিয়ে                                                                            উৎপাদিত ডিম মাওনা চৌরাস্তায় পৌঁছে দিতাম। সেখান থেকে তা চলে যেত রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে। এভাবে দিনমান কষ্ট করে মুরগির খাদ্য ও ওষুধ কেনা ছাড়া কোনো ব্যয়ই করিনি। লাভের টাকা জমিয়ে পর পর আরো তিনটি শেড নির্মাণ করি। একপর্যায়ে খামারে মুরগির সংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজার। বর্তমানে আমার খামারে ১৬টি শেডে ২৬ হাজার মুরগি (উৎপাদন) রয়েছে।’

    …………………………

    খামারিরা মুরগির খাদ্য কিনে অনেক সময় প্রতারিত হয়। অনেকে বুঝতে না পেরে ভেজাল খাদ্য কেনে। ফলে মুরগি রোগাক্রান্ত হয়, খামারে উৎপাদনও কমে যায়। এ আশঙ্কা থেকে তিনি খাদ্য প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে ধারণা নেন। পরে ভুট্টা, সয়াবিন, তুষসহ ১৭টি উপকরণ কিনে খামারের মুরগির খাবার নিজেই তৈরি করেন। সফল হওয়ার পর ওই লাভ থেকেই ব্যবসা আরো সম্প্রসারণ করেছেন তিনি। মুরগির খাদ্য ব্যবসাসহ ডেইরি ফার্মও রয়েছে তাঁর।
    তোফাজ্জল হোসেন জানান, ডিম খেলে রোগ হয়—দেশজুড়ে এমন অপপ্রচারসহ ২০০৭ ও ২০১২ সালে বার্ড ফ্লু সংক্রমণে পোল্ট্রি ব্যবসায় ধস নেমেছিল। ওই সময়ও তিনি হতাশ হননি। তবে সতর্ক ছিলেন। তাঁর খামারে মুরগি বার্ড ফ্লু সংক্রমিত হয়নি কখনো। তিনি বলেন, ‘শুরুর পর থেকেই                                                           আমার খামার পরিচ্ছন্ন। বাইরে থেকে কোনো পশু-পাখি খামারে ঢোকার কোনো সুযোগ রাখিনি। যখন-তখন যে কেউ খামারে চাইলেই যেতে পারত না। আমি নিজেও পরিচ্ছন্ন হয়ে খামারে কাজ করতাম। খুব প্রয়োজনে কেউ খামারে গেলে তাকে জীবাণুমুক্ত করে ঢুকতে দেওয়া হতো। এতে খামারে জীবাণু ছড়ায়নি। ফলে বেশির ভাগ সময় মুরগি সুস্থ থাকায় খামারে উৎপাদন বেশি হয়েছে।’ পোল্ট্রি ব্যবসায় আগ্রহী কিংবা নতুন আসা ব্যক্তিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘খামার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখুন। এতে মুরগি সুস্থ থাকবে, বাড়বে উৎপাদন।’

    স্থানীয় লোকজনের কাছে তোফাজ্জল হোসেন এখন একজন আদর্শ উদ্যোক্তা। নিজ গ্রাম ছাড়িয়ে পুরো উপজেলায় বেকার যুবকদের কাছে তিনি এক উদাহরণ। মাওনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম খোকন বলেন, ‘তোফাজ্জল হোসেন এলাকার বেকার যুবকদের কাছে দৃষ্টান্ত। তাঁর প্রেরণায় আশপাশের শখানেক যুবক পোল্ট্রি ব্যবসায় বিনিয়োগ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।’ তোফাজ্জল হোসেন আরো বলেন, পোল্ট্রি ব্যবসা শুরুর আগে                                                                           প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, ব্যবসা শুরুর পর তিনি যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়ে এ বিষয়ে আরো বেশি ধারণা পান। সব অভিজ্ঞতা তিনি তাঁর খামারে প্রয়োগ করেন। তিনি বলেন, ‘কোনো প্রশিক্ষণ বা ধারণা না নিয়েই অনেক বেকার যুবক ঝোঁকের বশে পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন তাঁরা।’ এ কারণে তাঁর গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের অনেক বেকার যুবকের জন্য বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন তিনি নিজ উদ্যোগে। স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে আগ্রহীদের এ ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করেন তিনি।

    পাশের সিংদীঘি গ্রামের পোল্ট্রি খামারি শোয়েব আহমেদ বলেন, ‘তোফাজ্জল হোসেনের তাগিদের ফলে                                                                       প্রথমে আমি যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিই। এরপর তাঁর (তোফাজ্জল) কাছ থেকে হাতে-কলমে ধারণা নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। পোল্ট্রি ব্যবসায় আমি লাভবান।’   পাশের বারতোপা গ্রামের মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ করে পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করে দু-দফা লোকসান গুনতে হয়। এতে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। পরে তোফাজ্জল হোসেনের পরামর্শে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিই। তাঁর কাছ থেকে হাতে-কলমে শিখেছি। এরপর আবার শুরু করি। এবার ফল পাই হাতে-হাতেই। এখন আমি লাভের মুখ দেখছি।’

    তোফাজ্জল হোসেন ২০০৮ সালে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী অঞ্জনা আক্তার গৃহিণী। ছয় বছর বয়সী হাসান ও হোসাইন নামের যমজ দুটি ছেলেশিশুর জনক তিনি।  সফল হওয়ার পর                                                   ওই লাভ থেকেই ব্যবসা আরো সম্প্রসারণ করেছেন তোফাজ্জল। বর্তমানে মুরগির খাদ্যের ব্যবসাসহ ডেইরি ফার্মও করেছেন তিনি।   মাওনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম খোকন বলেন, “তোফাজ্জল হোসেন এলাকার বেকার যুবকদের কাছে দৃষ্টান্ত। তাঁর প্রেরণায় আশপাশের শখানেক যুবক পোল্ট্রি ব্যবসায় বিনিয়োগ করে ‘প্রতিষ্ঠিত’ হওয়ার লড়াই করছেন।”
    তথ্যসূত্রঃ কালের কন্ঠ (২০ নভেম্বর, ২০১৭)