




…………………………





হাসপাতালের বিছানার মাথার দিকটি একটু উঁচু করে রাখায় তা অনেকটা চেয়ারের মতো হয়েছে। আর রোগীর খাবারের জন্য যে ছোট ট্রলি বা টেবিল, সেই টেবিলকে বানানো হয়েছে পরীক্ষা হলের বেঞ্চ। পাশের সোফায় বসে আছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক।
……..
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক হাসপাতালের চিত্র এটি। আজ বুধবার হাসপাতালের বিছানায় বসে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত জরাবিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন খাদিজা আক্তার। পরীক্ষার সময় পাশেই বেবি কটে ঘুমিয়ে ছিল মেয়ে। গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই মেয়ের জন্ম দেন খাদিজা।





…………………………





আজ বেলা তিনটার দিকে মোহাম্মদপুরের ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে কথা হয় খাদিজা ও তাঁর স্বামী আলী শাহরুফ মো. জীমের সঙ্গে। শরীরে কাটাছেঁড়া যন্ত্রণার পাশাপাশি পরীক্ষার ধকলে কাহিল থাকার কথা থাকলেও খাদিজার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছিল, এই মা পরীক্ষা দিতে পেরে কতটা খুশি হয়েছেন। বললেন, ‘গতকাল রাতে মেয়ের জন্ম হয়। পোস্ট–অপারেটিভে ছিলাম।
……..
আজ সকাল থেকে শুধু ভাবছিলাম, কখন আমাকে কেবিনে দেবে। কেবিনে এসে বার্ধক্যবিষয়ক জরাবিজ্ঞানের বইটি একটু নেড়েচেড়েও দেখেছি। শুধু মনে হয়েছে, আর একটু যদি পড়ে নিতে পারতাম। চিকিৎসক ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথানাশক ওষুধ দিয়েছিলেন। আর পরীক্ষার সময় শরীরের ব্যথার কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু মনে হয়েছে, যে করেই হোক, পরীক্ষাটা দিতে হবে। পরীক্ষা বেশ ভালোই হয়েছে।’—কথাগুলো বলেই আবার একগাল হাসি দিলেন খাদিজা। খাদিজার এর আগের পরীক্ষাটি ছিল ২৬ সেপ্টেম্বর।
খাদিজা ইডেন মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা হলে গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনায় পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। চলতি মাসের ৯ তারিখ পরীক্ষা শুরু হয়। আগের পরীক্ষাগুলো খাদিজা ঢাকা কলেজে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়েই দিয়েছেন। আগামী ৩ অক্টোবর তাঁর শেষ পরীক্ষা। খাদিজা আশা করছেন, শেষ পরীক্ষাটি তিনি কেন্দ্রে বসেই দিতে পারবেন।





…………………………





খাদিজা ও শাহরুফের বিয়ে হয় গত বছরের মার্চ মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যালয়ে আইটি বিভাগে কর্মরত আছেন শাহরুফ।
তবে ভেবেছিলাম, আমাদের মেয়ে তার মায়ের পেটে বসেই মাস্টার্স পরীক্ষা দেবে। কিন্তু তা আর হলো না। পরীক্ষা দিতে সে মায়ের পেট থেকে বাইরেই চলে এল।
শাহরুফ
তিনি হেসে বললেন, ‘তবে ভেবেছিলাম, আমাদের মেয়ে তার মায়ের পেটে বসেই মাস্টার্স পরীক্ষা দেবে। কিন্তু তা আর হলো না। পরীক্ষা দিতে সে মায়ের পেট থেকে বাইরেই চলে এল।’
কেবিনে খাদিজার বইও দেখালেন শাহরুফ। জানালেন, হাসপাতালে খাদিজার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য হাতে খুব কম সময় পাওয়া গেছে। হাসপাতালে বসেই শাহরুফ স্ত্রীর পরীক্ষার দরখাস্ত লিখেছেন। আজ সকালে তা যথাযথ স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন শাহরুফের চাকরিসূত্রে পরিচিতরা।
স্ত্রীর পরীক্ষার অনুমতি দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য খাদিজার চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শাহরুফ।
সময়ের আগেই মেয়ের জন্ম হয়ে গেছে, তাই খাদিজা ও তাঁর স্বামীর স্বজনদের বেশির ভাগই এখনো ঢাকায় পৌঁছাতে পারেননি। মোহাম্মদপুরে বাসায় থেকে হাসপাতালে খাদিজার খাবার পাঠানোসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত শাহরুফের মা। ফলে হাসপাতালে নতুন বাবা ও মা হওয়া এই দম্পতিকে সব সামলাতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। একটু পরপর ডাক পড়ছে হাসপাতালের আয়া সুফিয়ার। তিনিও বেশ যত্ন করেই বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে সহায়তা করাসহ বিভিন্ন দিক সামলাচ্ছেন।





…………………………





অস্ত্রোপচারের পর এভাবে পরীক্ষা দেওয়ায় খাদিজার কোনো শারীরিক ঝুঁকি আছে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের শিক্ষিকা সায়কা শহীদ টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের পর ১২ ঘণ্টা বেশ ভালোভাবেই পার করেছেন খাদিজা। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য খাদিজার মনোবল দেখেও অবাক হতে হয়। অস্ত্রোপচারের পর থেকে ও বেশ সুস্থ আছে এবং সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমিও তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিই। বসে পরীক্ষা দিতে হবে বলে পরীক্ষার আগে পেইনকিলার খেতে বলেছি। এখন পর্যন্ত সব দিক দেখে মনে হচ্ছে, খাদিজার বড় কোনো জটিলতা দেখা দেবে না।’
ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষিকা রুনা লায়লা আজ সকালেই জানতে পারেন, তাঁর পরীক্ষার ডিউটি পড়েছে হাসপাতালে। রুনা লায়লা বললেন, ‘প্রায় ১৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনে হাসপাতালে পরীক্ষার গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ঘটনা এটাই প্রথম। সেই দিক থেকে এটি আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর একটি। শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় কোনো ছাড় দিইনি। পরীক্ষার্থীও বাড়তি কোনো সুবিধা চাননি। এই মা ও মেয়ের সঙ্গে ইচ্ছে করেই আমি একটি ছবি তুলে রেখেছি। এই পরীক্ষার্থী আবার প্রমাণ করেছেন, মায়েরা সবই পারেন।’
মাস্টার্স পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান পারভীন সুলতানা হায়দার। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘মানবিক বিষয়ের পাশাপাশি আইনেও জরুরি পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়ার বিধান আছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, যাতে এ পরীক্ষার্থীর একটি বছর নষ্ট না হয়। এ পরীক্ষা দিতে না পারলে সামনের বছর আবার সব পরীক্ষা দিতে হতো তাঁকে।’
সদ্য বাবা হওয়া শাহরুফ মেয়ের প্রশংসা করছিলেন বারবার। বললেন, ‘মা যখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, তখন মেয়ে প্রায় পুরো সময়টাই ঘুমে ছিল। আমি দরজার বাইরে থেকে একটু পরপর উঁকি দিয়ে দেখছিলাম। আমাদের এক ভাগনি বসে ছিল মেয়ের পাশে। মা ও মেয়ের একসঙ্গে পরীক্ষা দেওয়ার বেশ কয়েকটি ছবিও তুলে রেখেছি মুঠোফোনে।’
পরীক্ষার অনুমতি দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বাহালুল হক চৌধুরী, ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল আই কে সলিমুল্লাহ্ খন্দকার, খাদিজার চিকিৎসক সায়কা শহীদসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শাহরুফ।