রাজশাহী নগরীর অদূরে অকট্রয় মোড় সংলগ্ন একটি জায়গা। সেখানে ছোট একটি বাসা। চারদিকে গাছপালায় আচ্ছাদিত। সেখানে গাছের ছায়ার নিচে ছোট্ট একটি বাঁশের তৈরি ঘর। ঘরটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ব্লিডিং ফার্ম হাউস’। এটিকে সাধারণত মাইক্রো হেবিটেট বলা হয়। ঘরের চারদিকে নীল রঙের জাল বা নেট দিয়ে ঘেরা। ঘরটির ভেতরে ছোট আকৃতির কদবেল, জামরুল, পেয়ারা, মাল্টা, পাতাবাহার, তুঁতসহ আরো কিছু গাছ। সেসব গাছ, গাছের পাতা, বাঁশের উপর বসে আছে বেশ কিছু শামুক। আর এভাবেই ঘরটিতে বিলুপ্তপ্রায় শামুকের কৃত্রিম প্রজনন হচ্ছে।
বিলুপ্তপ্রায় এই গেছো শামুকের কৃত্রিম প্রজনন ঘটাচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ড. এম শারিয়ার শোভন। এরইমধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে শতভাগ সফলও হয়েছেন তিনি।
গেছো শামুক
গেছো শামুক সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষক ড. এম শারিয়ার শোভন জানান, এই শামুকগুলো এমফিড্রোমাস প্রজাতির। এদের সাধারণত গেছো শামুকের ‘রাজা’ বলা হয়ে থাকে। সাধারণ শামুক অনেকগুলো ডিম দেয়। কিন্তু গেছো শামুক সে তুলনায় কম ডিম দেয়। গেছো শামুক সাধারণত রাতে চলাচল করে। আর দিনের আলোতে লুকিয়ে থাকে। এদের আদি নিবাস আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে।
গবেষণা শুরুর গল্প
শামুক নিয়ে গবেষণার শুরুর গল্প সম্পর্কে এই গবেষক বলেন, জাপানে শামুকের ফেরোমন নিয়ে গবেষণা করার সময় মূলত দেশীয় শামুক নিয়ে গবেষণার প্রতি আগ্রহ জন্মে। জাপানের এক গবেষক বিলুপ্তপ্রায় গেছো শামুক নিয়ে গবেষণার পরামর্শ দেয়। এর আগে যদিও দেশি শামুক নিয়ে একটি সার্ভে করেছিলাম। সেখানে দেখতে পাই আমাদের দেশে গেছো শামুক খুবই দুর্লভ প্রকৃতির। এই জাতীয় শামুক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়। যদিও তার পরিমাণ খুব কম।
শামুকের খোঁজে চট্রগ্রাম
দেশে ফিরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গেছো শামুক খুজেছেন তিনি। দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই শামুকের সন্ধান পান। নির্বিচারে বৃক্ষ, বনজঙ্গল নিধন, পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বিলুপ্তপ্রায় এই প্রজাতির শামুকগুলো। পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চারটি গেছো শামুক বাসায় নিয়ে এসে ক্যাপটিভ প্রজনন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এই গবেষক।
প্রজননে সফলতা
ড. এম শারিয়ার শোভন বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা প্রকল্পের অর্থায়নে প্রায় ১ বছরের প্রচেষ্টা শেষে প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। ইতোমধ্যে ৪টি প্রাপ্ত বয়স্ক শামুক ১২টি বাচ্চা দিয়েছে। জাপানের তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দলের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় এই গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ সরকারি সহযোগিতা পেলে বৃহৎ পরিসরে গেছো শামুক নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন এই গবেষক।
গেছো শামুকের উপকারিতা
ড. শাহরিয়ার শোভন বলেন, কৃষি জমিতে বড় এক ধরনের শামুক দেখা যায়। যারা গাছপালা খেয়ে ফেলে ফসলের ক্ষতি করে। কিন্তু গেছো শামুক গাছেই থাকে, অথচ গাছের কোন ক্ষতি করে না। বরং উদ্ভিদের গায়ে যেসব ক্ষতিকর অণুজীব লেগে থাকে, সেগুলো খেয়ে উদ্ভিদকে রক্ষা করে। এছাড়াও গুটি কয়েক দেশে থাকা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই শামুকগুলো দেশের জাতীয় ঐতিহ্যের আওতায় পরে।
গেছো শামুক রক্ষায় করণীয়
গেছো শামুক রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষক শোভন বলেন, বনাঞ্চল কেটে বসতবাড়ি বা বিভিন্ন বাগান লাগানোর ফলে এই শামুকগুলো প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। এই শামুকগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। প্রধানমন্ত্রী চাইলে এসব শামুকের প্রজননের জন্য কিছু বনাঞ্চল সংরক্ষণ করে টুরিস্ট স্পট গড়ে তুলতে পারেন। এতে একদিকে এই শামুক বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে অন্যদিকে বনাঞ্চল সংরক্ষণ হবে পাশাপাশি দেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। বিলুপ্তপ্রায় এই গেছো শামুক সংরক্ষণে দেশের বনাঞ্চল সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন।