রোপণ থেকে উৎপাদন, কী নেই এতে। যেন এক দরজায় কৃষির সব সেবা (ওয়ান স্টপ সেবা)। বলছিলাম কৃষি খাতের ইয়ন গ্রুপের কথা। পোলট্রি, গবাদিপশু, মৎস্য, শস্য—কৃষির এসব খাত নিয়ে গ্রুপটির কার্যক্রম। পাশাপাশি রয়েছে ভোগ্যপণ্য, রেস্টুরেন্টসহ আরও অনেক ব্যবসা। ২০০০ সালে ছোট পরিসরে কার্যক্রম শুরু করা ইয়ন অ্যানিমেল হেলথ এখন একটি গ্রুপ প্রতিষ্ঠান।
কৃষির স’ঙ্গে জড়িতরা ইয়নকে চেনেন নানাভাবে। গ্রুপটির ২০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় আড়াই হাজার ক’র্মী সারা দেশে ছ’ড়িয়ে আছেন। যতটা না ব্যবসা, তার চেয়ে বেশি নি’রাপদ খাদ্য নি’শ্চিতে মনোনিবেশ বেশি ইয়নের। এমন চিন্তা থেকেই গত মাসে অস্ট্রেলিয়া থেকে ২২৫টি গাভি এনেছে প্রতিষ্ঠানটি। রংপুর জে’লার বদরগঞ্জ উপজে’লায় ডেইরি ফার্মের জন্য উড়োজাহাজে আনা হয় এসব গাভি। আর এরপরেই নানা আলোচনায় জায়গা করে নেয় ইয়ন গ্রুপ।
ইয়নের উত্থান ও ব্যবসায়িক গল্প শুনতে গিয়েছিলাম গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ব্যব’স্থাপনা পরিচালক মোমিন উদ দৌলার কাছে। তেজগাঁওয়ে নিজস্ব কার্যালয়ে বসে অল্প কথাতেই জা’নিয়ে দিলেন, ‘কৃষিতে নতুন কিছু উদাহরণ তৈরি ক’রতে চেয়েছিলাম। সেটা ক’রতে পেরেছি। এখন নি’রাপদ খাদ্যের দিকেই সব মনোযোগ।’ মোমিন উদ দৌলা বলেন, ‘অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে খাবারের মূল্য কম না। তবে মানে অনেক পিছিয়ে। আম’রা সেই মান নি’শ্চিতেই লড়ছি। নি’রাপদ ও স্বা’স্থ্যকর খাবার নি’শ্চিতে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের শুরু হতে হবে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে। কাঁচামাল নিজে’র হলে এবং তার মান ঠিক থাকলে পুরোপুরি নি’রাপদ বলা যায়।
চাকরিজীবী থেকে উদ্যোক্তা: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে’র পর মোমিন উদ দৌলা ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। প্রথম বর্ষ শেষ না হতেই ১৯৮৮ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। পেপারডাইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যব’স্থাপনা বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর সেখানেই চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে দেশে ফি’রে চাচার পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন, সেটাও ছিল কৃষিভিত্তিক। আড়াই বছর পরেই নিজস্ব চিন্তা–চেতনা থেকে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধা’ন্ত নেন। ২০০০ সালে গড়ে তোলেন ইয়ন অ্যানিমেল হেলথ প্রোডাক্টস। মোমিন উদ দৌলা বলেন, ‘আমা’র উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের স’ঙ্গে কাজ কর।। প্রযু’ক্তি যুক্ত করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বদল দেওয়া।’ কৃষিতে ব্য’তিক্রম কিছু করাই ছিল মোমিন উদ দৌলার উদ্দেশ্য। বলছিলেন, ‘যেভাবে কৃষি হয়ে আসছিল, তা পরিবর্তন ক’রতে চেয়েছিলাম। কৃষিকে আধুনিক ক’রতে চেয়েছিলাম। অনেকটা হয়েছে। কৃষির সব খাতেই আম’রা এখন কাজ করছি।’
যেভাবে উত্থান: ইয়ন শুরু করেছিল পোলট্রিশিল্প দিয়ে। এরপর মাছ, শস্য, গবাদিপশু। এখন সব ধ’রনের কৃষকই ইয়নের সহায়তা নিতে পারে। ২০০৩ সালে পুকুরে মাছ চাষ বা অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতি চালু করে ইয়ন। ২০০৬ সালে শস্য বা বীজ উৎপাদন শুরু করে। আর ২০০৮ সালে শুরু গবাদিপশু নিয়ে। মোমিন উদ দৌলা বলেন, ‘কৃষি খাতের সব স’মস্যার সমাধান আমাদের কাছে আছে। কৃষকদের থেকেই সরাসরি আম’রা শিখেছি।
কাজে’র মাধ্যমেই আম’রা এসব অর্জন করেছি।’ তিনি আরও বললেন, ‘বাংলাদেশে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে আমা’র পা প’ড়েনি। ২০০০ সালে যেসব ক’র্মী কে নিয়ে কাজ শুরু হয়, এখনো তাঁরা আমাদের স’ঙ্গে আছেন। সবাই মিলে আম’রা এগিয়ে যাচ্ছি। আম’রা কৃষি খাতে একটা উদাহরণ তৈরি ক’রতে পেরেছি। এটা এখন অনেকেই অনুসরণ করছে। মৎস্য ও গবাদিপশু পা’লন খাতে আম’রা এমন সেবা এনেছি, যা এখন অনেকেই অনুসরণ করছে। এটা চলবে। প্রতিদিন এসব সেবা হালনাগাদ ক’রতে হবে।’
ইয়ন যা করে: আপনি যদি পোলট্রি খামা’রি হয়ে থাকেন, তাহলে প্রথমে প্রয়োজন চাহি’দামতো আবাসনের ব্যব’স্থা করা। এরপর বাচ্চা। বাচ্চাদের লালনপা’লনের জন্য আবার যথাযথ পরিবেশ নি’শ্চিত ক’রতে হবে। এরপর দিতে হবে খাবার। ভালো মানের ভ্যাকসিনও দিতে হবে। অসুখ হলে দিতে হবে ওষুধ। এর সব ধ’রনের সেবাই দিচ্ছে ইয়ন। প’রামর্শ থেকে শুরু করে বাচ্চা, ওষুধ, খাবার, ভ্যাকসিন—সব।
মোমিন উদ দৌলা বলেন, ‘এসব সেবার জন্য আমাদের দেশি–বিদেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক’র্মকর্তা রয়েছেন। স্বা’স্থ্যকর পরিবেশে আম’রা বাচ্চা ও খাবার উৎপাদন করি। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন হয় না, তাই ইউরোপ থেকে আম’রা এটা নিয়ে আসছি। রোপণ থেকে শুরু করে ফলানো পর্যন্ত সব ধ’রনের সেবাই প্রদান করা হয়।’ ঠিক একইভাবে মৎস্য, গবাদিপশু সম্পদ খাতেও সব ধ’রনের সেবা দেয় ইয়ন। এখন তেলাপিয়া, শোল মাছের পোনাও করা হচ্ছে।
মাছের সব ধ’রনের খাবারও করছে। পুকুর প্র’স্তুত, পানির মান ঠিক করা—সব সেবাই রয়েছে ইয়নের। গবাদিপশু সম্পদেও আম’রা একই সেবা দিচ্ছি। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা গরু থেকে সামনে বাছুর করার প’রিকল্পনা করছে গ্রুপটি। মোমিন উদ দৌলা বলেন, ‘আশা করছি, এ থেকে ভালো মানের পশু উৎপাদিত হবে; যাতে দুধ উৎপাদন অনেক বাড়বে।’ এ ছাড়া চাল, গম, ভুট্টা, সবজিসহ নানা ধ’রনের বীজ করে থাকে ইয়ন। কৃষি কেমিক্যাল করে থাকে। আবার অর্গানিক সারও উৎপাদন করে। টিস্যু কালচার থেকে বীজও উৎপাদন করে। ভারতের প্রীত ট্রাক্টরও বাজারজাত করে ইয়ন।
মোমিন উদ দৌলা বলেন, ‘এসবের মাধ্যমে আম’রা সারা দেশের কৃষকদের স’ঙ্গে জড়িত। সারা দেশে আমাদের ২০ হাজার ডিলার আছে। প্রতিদিন আমাদের ক’র্মী রা সরাসরি কৃষকদের স’ঙ্গে কথা বলছে। তারা স’মস্যা জানছে এবং আম’রা তা সমাধানের চেষ্টা করছি।’আবার ভোক্তাদের কাছে নি’রাপদ খাদ্য পৌঁছে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে কান্ট্রি ন্যাচারাল ব্র্যান্ড। এর মাধ্যমে হিমায়িত মুরগি, নাগেটসসহ নানা ধ’রনের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে। ব্যাংক যখন ব’ন্ধু: বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর হাত ধ’রে গড়ে উঠেছে বেশির ভাগ উদ্যোক্তা। ঠিক এমনটি ইয়ন গ্রুপেরও। বলা যায় শূন্য হাতে শুরু করে ইয়ন গ্রুপ। বড় বোনের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ব্যবসায় নামেন মোমিন উদ দৌলা। মহাখালীর ডিওএইচএস ছিল প্রথম অফিস।
মোমিন উদ দৌলা বলেন, ‘শুরু থেকে ব্যাংকগুলো আমাদের স’ঙ্গে ছিল। অনেক সহায়তা করেছে। আমাদের মধ্যে বিশ্বস্ততার স’স্পর্ক গড়ে উঠেছে। ব্যাংকগুলো জানত, আম’রা ব্য’র্থ হব না।’ ব্যবসার শুরু থেকে প্রায় ১০ বছর এবি ব্যাংকের ঋণ সহায়তা পেয়েছিল ইয়ন গ্রুপ। এখন মিউচুয়াল ট্রাস্ট, দি সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ সহায়তা পায় গ্রুপটি।যোগাযোগ করা হলে সিটি ব্যাংকের ব্যব’স্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘ইয়ন গ্রুপ আমাদের ভালো গ্রাহকদের একজন। তারা নি’রাপদ খাদ্য নি’শ্চিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। এভাবেই বাংলাদেশ একদিন নি’রাপদ খাদ্যের দেশ হয়ে উঠবে। এমন গ্রাহকদের পাশে থাকতে পেরে আম’রা আনন্দিত।’
স্বপ্ন দুগ্ধশিল্পে: সুইডেনের ডি লেভেল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি নকশা অনুযায়ী ইয়ন বায়ো সায়েন্স ডেইরি ফার্মে গরুর বাসস্থান নি’র্মাণ করেছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে এনেছে গাভি। দুধ দোহনের জন্য স্থাপন করেছে স্বয়ংক্রিয় মিল্কিং পারলার। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করবে ইয়।।
সরকারের কাছে চাওয়া: সরকার যে নীতিমালা করছে, তা ব্যবসাবান্ধব হতে হবে। তাহলে সবাই উপকৃত হয়। স’ম্প্রতি বন্দরের এক আদেশে পোলট্রি খাতে শতকোটি টাকার ক্ষ’তি হয়েছে। বিদেশে কৃষি খাতে কোনো কর দিতে হয় না। এ জন্য কৃষি খাতকে করমু’ক্ত ঘো’ষণা দিতে হবে। কৃষি খাত ও প্রবাসী আয়ের কারণে সারা দেশে ঘরে ঘরে উন্নয়ন হয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হওয়ায় গ্রামেও টেলিভিশন, ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। কর কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই গিয়ে প’ড়ে। এর নেতিবাচক প্র’ভাব অনেক বেশি। আম’রা বছরে চার হাজার কোটি টাকার দুধ আমদানি করছি। এখন যদি ডিমও বিদেশ থেকে আনতে হতো, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াত। তাই সরকারের কাছে অনুরো’ধ, আমাদের স’ঙ্গে নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো ( সানাউল্লাহ সাকিব, প্র’কাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯)