Fri. Jun 9th, 2023

    …………………………

    সৌদি আরবে গিয়ে মেয়েটা লা’শ হয়ে ফিরেছে । ১৫ বছরের এই মেয়েকে ২৫ বছর হিসেবে দেখিয়ে সৌদিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেখানে গিয়ে মেয়েটার ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা সহজেই বুঝা যাচ্ছে।
    ……
    তবুও ভাগ্য ভালো, তার মৃতদেহ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অতপর মেয়েটার পরিবার দাবি করেছে যে মৃতদেহের ময়না তদন্ত হোক। কিন্তু বাংলাদেশের কর্তা ব্যক্তিরা তা হতে দেননি! হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন- যে দেশে মেয়েটা জন্মেছিল; তরা বাবা-মাও যে দেশে জন্মেছিল; যে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য এই মেয়েটার মতো লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়।

    …………………………

    সেই দেশের সরকারি কর্তারা সোজা বলে দিয়েছেন যে ময়না তদন্ত করা সম্ভব না। সৌদি সরকার বলেছেন,মেয়েটা স্ট্রোক করে মারা গিয়েছে। তাই এটাই শেষ কথা।

    কেউ কি আমাকে বলবেন যে মৃত সৌদি ফেরত সকল মেয়েগুলোই কেন স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছেন? মেয়েটার প্রকৃত বয়স ছিল যেখানে ১৫, সেখানে তার বয়স কি করে ২৫ করা হলো? কে বা কারা এটার সাথে জড়িত ছিল? ঠিক আছে, মেনে নিলাম ১৫ বছর বয়েসেই মেয়েটা গিয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সেটা কি এই মেয়েটাকে কিংবা এমন অন্য সবাই যারা যায়, তাদেরকে কি শেখানো হয়? ধরে নিলাম, সৌদি রাজা-মহা রাজারা এই মেয়েটার উপর কোন পাশবিক নির্যাতন করেননি কিন্তু সেখানকার সংস্কৃতি এবং খাদ্য অভ্যাস? এই মেয়েটার সেখানকার মানুষের ভাষা সম্পর্কে কি কোন ধারণা ছিল?

    এসব মেয়েরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেখানকার বাসা-বাড়িতে কাজ করতে যায়। আমি চিন্তা করছিলাম আমার নিজের কথা। আজ থেকে ১৮ বছর আগে যখন আমি ইউরোপে পড়তে আসি; তখন শিক্ষিত এই আমাকেই তো নানান রকম অজানা বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

    সুইডেনে পা দিয়েই যখন জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হচ্ছিলাম তখন দেখি গাড়ি আসতেছে। আমি থেমে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি; দেখি গাড়িও থেমে গিয়েছে! আমি পার হচ্ছি না দেখে ড্রাইভার নেমে এসে আমাকে বলেছেন, তুমি মনে হয় এই দেশে নতুন এসেছ । আমাদের এখানে মানুষ আগে। তোমাকে রেখে এই ক্রসিংয়ে যদি আমি চলে যাই, পরের ক্রসিং এ আমার জরিমানা হবে। তুমি দয়া করে পার হও! তো বাংলাদেশ থেকে আসা এই আমি সেটা কি করে জানবো?

    …………………………

    ছাত্র হোস্টেলে থাকা শুরু করেছি, দেখি কাপড় ধোঁয়ার জন্য অনলাইনে লন্ড্রির বুকিং দিতে হয় ! আজ থেকে ১৮ বছর আগের কথা বলছি! আমি তো তখন বুঝতেই পারছিলাম না- এটা কি করে সম্ভব! কিভাবে বুকিং দিতে হয় অন্য আরেকজনের কাছ থেকে শিখতে হয়েছে।

    শুধু বুকিং দিলেই তো আর সব শেষ হয়না। আজ থেকে ৮-১০ বছর আগে আমাদের ঢাকার বাসায় ওয়াসিং মেশিন এসেছে । এর আগে তো ওয়াসিং মেশিন ছিল না। তো ১৮ বছর আগের এই আমি কি করে জানবো যে ওয়াসিং মেশিন কি করে চালায়? সেটাও শিখতে হয়েছে। শিখতে হয়েছে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে কি করে ঘর পরিষ্কার করতে হয়?

    রান্না করতে গিয়ে দেখি- চুলা হচ্ছে স্বচ্ছ কাঁচ! দেখেই ভাবলাম,এটা কি করে সম্ভব! এই চুলা দিয়ে কি করে রান্না করবো? আজীবন তো গ্যাসের তিন কোনা চুলা দেখেই অভ্যস্ত হয়ছি! তারপর জানতে পারলাম- এইসব হচ্ছে ইলেকট্রিক চুলা। স্রেফ বাটন চেপে ঘাট ঠিক করে দিলেই চুলা গরম হয়ে যায়!

    ঘরের কাজের এইসব তো গেল। আমাকে অন্তত কোন সুইডিশ কিংবা বিদেশির সাথে থাকতে হয়নি। আমি ছিলাম আমার মতো করে ছাত্র হোস্টেলে। তাই নিজের মতো করে থাকতে পারতাম। খাওয়া দাওয়াও নিজের মতো করে করতে পারতাম।

    …………………………

    আমার মনে আছে আমার এক সুইডিশ বন্ধু তার বাসায় আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। তার মা মনের আনন্দে আমার জন্য অনেক কিছু রান্না করেছেন। সন্ধ্যায় ওদের বাসায় গেলাম। খেতে গিয়ে দেখি এমন সব খাদ্য যে গলা দিয়ে আর নামছে না।

    আলু সেদ্ধ, তাও কোন রকম লবন-মরিচ ছাড়া। স্যামন মাছ মনে হচ্ছে অর্ধেক সেদ্ধ করে রেখেছে, মুখেই দেয়ার উপায় নেই! চিংড়ি মাছ মনে হলো, পুরোই কাঁচা! তো, এইসব খাওয়া দেখে তো আমার বমি আসার জোগাড়! তারপরও অনেক কষ্টে ভাব করেছি- খুবই চমৎকার হয়েছে।

    এখন আপনিই চিন্তা করুন, একটা লেখাপড়া না জানা ১৫ থেকে ২০ বছরের মেয়ে যখন সৌদি আরবে কারো বাসায় কাজ করতে যায়, তাকে তো আমার চাইতে আরও বেশি নানান সব অজানা বিষয়ের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে।

    প্রতিদিন তাকে যে খাবার দেয়া হয়, সেটা তো সৌদিদের খাবার। তার জন্য নিশ্চয় আলাদা কোন খাবার রান্না করা হয়নি। এখন এই মেয়ে কি এই খাবারে অভ্যস্ত? তাকে কি আগে থেকে এই বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে কিংবা উপরে আমি যেসব অভিজ্ঞতার কথা বললাম?

    এদেরকে নাকি এক মাসের না কয় মাসের ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু সেই ট্রেনিং এ নাকি কিছুই শেখায় না।

    তাহলে এই মানুষ গুলো সম্পূর্ণ নতুন একটা দেশে, একটা বিদেশি পরিবারের সাথে কি করে থাকবেন? তার সাথে যুক্ত করে নিন পাশবিক নির্যাতনের ব্যাপার।

    …………………………

    এই যখন অবস্থা। এইসব বিষয় নিয়ে যখন ভাবার কথা; তখন আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- বিদেশে থাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশন মানে দূতাবাস গুলোতে)কীভাবে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে কাজ হয় সেটা দেখার জন্য আমেরিকা-ইংল্যান্ড সহ ৯টি দেশে তারা সফরে যেতে চান!

    এই হচ্ছে আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অবস্থা।যেই মানুষ গুলো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, মৃত লাশ হয়ে ফিরে দেশের অর্থনীতি সচল রাখতেছে; সেই মানুষ গুলো মরে যাবার পর- কেন মারা গেল, সেটা জানার জন্য ময়না তদন্ত পর্যন্ত করা যায় না।

    আর এই মানুষ গুলোর পাঠানো টাকায় যেই দেশ চলছে; সেই দেশের সরকারি কর্তারা, বিসিএস ক্যাডাররা ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি করে কিংবা নানান সময় বিদেশ ভ্রমণ করে ; লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়ে ক্যানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়ে সেখানে বউ-বাচ্চা রেখে আসে।

    এরপরও এরাই নাকি দিন শেষে দেশ প্রেমিক বিসিএস ক্যাডার কিংবা সরকারি আমলা!

    লেখক-আমিনুল ইসলাম

    (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত,সূত্র-দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন)